বৈদ্যুতিক জগৎ এক বিস্ময়কর ক্ষেত্র, যেখানে আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ কিছু বিষয়ও গভীর ঐতিহাসিক এবং প্রযুক্তিগত প্রেক্ষাপট ধারণ করে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুতের ব্যবহার অপরিহার্য, এবং আমরা সাধারণত আমাদের বাড়িতে ২২০ ভোল্টের এসি (অল্টারনেটিং কারেন্ট) সরবরাহ দেখে থাকি। তবে, উত্তর আমেরিকায় (যেমন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা) এই স্ট্যান্ডার্ডটি ১২০ ভোল্ট। এই ভিন্নতার কারণ কী? কেন দুটি ভিন্ন মহাদেশ দুটি ভিন্ন ভোল্টেজ স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহার করে? আসুন, এই রহস্যের গভীরে ডুব দেওয়া যাক।
ছবিঃ সংগৃহীত |
বিদ্যুৎ বিতরণের ঊষালগ্ন: "কারেন্টের যুদ্ধ" এবং ভোল্টেজের ভিত্তি স্থাপন:
উনিশ শতকের শেষদিকে যখন বিদ্যুতের বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয়, তখন দুটি প্রধান প্রযুক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিল: টমাস এডিসনের উদ্ভাবিত ডিরেক্ট কারেন্ট (DC) এবং নিকোলা টেসলার প্রবর্তিত অল্টারনেটিং কারেন্ট (AC)। এডিসন ডিসি বিদ্যুতের নির্ভরযোগ্যতার উপর জোর দিলেও, এর একটি বড় সীমাবদ্ধতা ছিল - এটিকে দীর্ঘ দূরত্বে প্রেরণ করা অত্যন্ত কঠিন এবং ব্যয়বহুল ছিল। ভোল্টেজ পরিবর্তন করাও ডিসিতে জটিল প্রক্রিয়া ছিল।
ঠিক এই সময়ে, টেসলার এসি সিস্টেম একটি বিপ্লবী সমাধান নিয়ে আসে। ট্রান্সফরমারের মাধ্যমে এসি ভোল্টেজকে সহজেই বাড়ানো বা কমানো যায়, যা বিদ্যুৎকে উচ্চ ভোল্টেজে দূরবর্তী বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কম ক্ষতিতে পরিবহন করে গ্রাহকদের কাছে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব করে তোলে। এই উদ্ভাবনই আধুনিক বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে।
তবে, বিদ্যুতের প্রাথমিক যুগে বৈদ্যুতিক সুরক্ষা ব্যবস্থা আজকের মতো উন্নত ছিল না। সেই সময়কার প্রকৌশলীরা মনে করতেন, তুলনামূলকভাবে কম ভোল্টেজ (যেমন ১১০-১২০ ভোল্ট) ব্যবহার করলে বৈদ্যুতিক শক এবং আগুনের ঝুঁকি কিছুটা কমানো যায়। এছাড়াও, সেই সময়ে উৎপাদিত অনেক প্রাথমিক বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এই নিম্ন ভোল্টেজের জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। উত্তর আমেরিকায় এই ধারণাটি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে এবং তারা ১২০ ভোল্টকে তাদের স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে গ্রহণ করে।
প্রযুক্তিগত বিবর্তন এবং ভোল্টেজের দক্ষতা:
সময়ের সাথে সাথে বিদ্যুৎ প্রযুক্তি আরও উন্নত হয়েছে। প্রকৌশলীরা বুঝতে পেরেছেন যে উচ্চ ভোল্টেজে বিদ্যুৎ প্রেরণ করলে বৈদ্যুতিক তারে রোধের কারণে বিদ্যুতের অপচয় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায় (\text{P}_{\text{loss}} = I^2R, যেখানে \text{P}_{\text{loss}} হলো অপচয় হওয়া শক্তি, I হলো কারেন্ট এবং R হলো রোধ)। উচ্চ ভোল্টেজে একই পরিমাণ শক্তি প্রেরণের জন্য কম কারেন্টের প্রয়োজন হয়, ফলে অপচয়ও কম হয়।
ইউরোপের দেশগুলো পরবর্তীতে এই বিষয়টি উপলব্ধি করে এবং তারা ২২০-২৪০ ভোল্টের স্ট্যান্ডার্ডে চলে আসে। উচ্চ ভোল্টেজ ব্যবহারের ফলে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা আরও বেশি দক্ষ এবং সাশ্রয়ী হয়ে ওঠে।
আমেরিকার প্রেক্ষাপট: ঐতিহ্যের ভার ও পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ:
অন্যদিকে, আমেরিকা যখন তাদের জাতীয় বিদ্যুৎ বিতরণ অবকাঠামো স্থাপন করছিল, তখন ১২০ ভোল্ট ইতিমধ্যেই একটি প্রতিষ্ঠিত স্ট্যান্ডার্ডে পরিণত হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ বাড়িঘর এবং শিল্পকারখানা এই ভোল্টেজের সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত ছিল। এই পরিস্থিতিতে একটি সম্পূর্ণ নতুন ভোল্টেজ স্ট্যান্ডার্ডে পরিবর্তন করা অর্থনৈতিকভাবে বিশাল ধাক্কা দিত এবং জনগণের জন্যেও অনেক অসুবিধার সৃষ্টি করত।
যদিও আমেরিকায় স্ট্যান্ডার্ড ভোল্টেজ ১২০ ভোল্ট, কিছু উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন সরঞ্জাম, যেমন ওয়াটার হিটার, এয়ার কন্ডিশনার এবং ইলেকট্রিক স্টোভ চালানোর জন্য ২৪০ ভোল্টের সংযোগও ব্যবহার করা হয়। এই ২৪০ ভোল্ট মূলত দুটি ১২০ ভোল্টের লাইনের সমন্বয়ে গঠিত হয় (ফেজ-টু-ফেজ সংযোগ)।
সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব:
ভোল্টেজ স্ট্যান্ডার্ডের এই পার্থক্য কেবল প্রযুক্তিগত বিষয় নয়, এর কিছু সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবও রয়েছে। বিভিন্ন ভোল্টেজের জন্য ডিজাইন করা বৈদ্যুতিক সরঞ্জামগুলি একে অপরের দেশে ব্যবহার করার জন্য প্রায়শই ভোল্টেজ কনভার্টারের প্রয়োজন হয়। এটি ভ্রমণকারীদের এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি অতিরিক্ত বিষয়।
উপসংহার:
আমাদের দেশে ২২০ ভোল্ট এবং আমেরিকায় ১২০ ভোল্ট ব্যবহারের ভিন্নতা মূলত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত, প্রাথমিক যুগের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং পরবর্তীকালে অবকাঠামো পরিবর্তনের অর্থনৈতিক ও ব্যবহারিক চ্যালেঞ্জের ফল। ইউরোপীয় দেশগুলো বিদ্যুতের দক্ষতা এবং দূরপাল্লার পরিবহনের সুবিধা বিবেচনা করে উচ্চ ভোল্টেজ স্ট্যান্ডার্ড গ্রহণ করলেও, আমেরিকা তাদের দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত ১২০ ভোল্টের অবকাঠামো বজায় রেখেছে। উভয় স্ট্যান্ডার্ডেরই নিজস্ব সুবিধা এবং অসুবিধা রয়েছে, তবে সময়ের সাথে সাথে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নতি বিশ্বব্যাপী একটি সমন্বিত স্ট্যান্ডার্ডের দিকে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা রাখে।