সান্ডা নামক সরীসৃপ প্রাণীটি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা নিয়ে মুসলিম বিশ্বে বিভিন্ন মতামত বিদ্যমান। বাহ্যিক অপছন্দের কারণে অনেকে এটি পরিহার করলেও, ইসলামিক শরিয়তে এর বিধান কী, তা কুরআন, হাদিস ও বিভিন্ন মাজহাবের আলোকে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা যাক।
সান্ডা। ছবি : সংগৃহীত |
কুরআনের নির্দেশনা:
কুরআন মাজিদে সরাসরি সান্ডা বিষয়ক কোনো আয়াত নেই। তবে সাধারণভাবে আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَقَدْ فَصَّلَ لَكُم مَّا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلَّا مَا اضْطُرِرْتُمْ إِلَيْهِ ۗ وَإِنَّ كَثِيرًا لَّيُضِلُّونَ بِأَهْوَائِهِم بِغَيْرِ عِلْمٍ ۗ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِالْمُعْتَدِينَ
"এবং তিনি তোমাদের জন্য বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন যা তোমাদের উপর হারাম করেছেন, কিন্তু যা তোমরা নিরুপায় হয়ে ভক্ষণ করেছ তা ব্যতীত। আর নিশ্চয়ই অনেকে অজ্ঞতাবশতঃ তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে বিপথগামী করে। নিশ্চয়ই তোমার পালনকর্তা সীমালংঘনকারীদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন।" [সূরা আল-আন'আম, আয়াত ১১৯]
এই আয়াত অনুযায়ী, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো খাদ্য স্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তা হালাল হিসেবে গণ্য হতে পারে।
হাদিসের আলোকে:
সান্ডা খাওয়া প্রসঙ্গে বেশ কিছু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
ضُبٌّ أُهْدِيَ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَمْ يَأْكُلْهُ وَلَمْ يَنْهَ عَنْ أَكْلِهِ
"রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে একটি সান্ডা হাদিয়া হিসেবে আনা হলো। তিনি তা খেলেন না, তবে তা খেতে নিষেধও করেননি।" [সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৫৪৯৯]
অন্য একটি বর্ণনায় খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রা.) বলেন:
أُتِيَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِضَبٍّ مَشْوِيٍّ فَأُتِيَ بِهِ إِلَيْهِ فَقَالَ مَا هَذَا قَالُوا ضَبٌّ يَا رَسُولَ اللَّهِ فَتَقَبَّضَ مِنْهُ فَقَالَ إِنَّهُ لَيْسَ بِأَرْضِ قَوْمِي فَأَجِدُنِي أَعَافُهُ قَالَ خَالِدٌ فَاجْتَرَرْتُهُ فَأَكَلْتُهُ وَرَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَنْظُرُ إِلَيَّ فَلَمْ يَنْهَنِي
"নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ভুনা সান্ডা আনা হলো। তা তাঁর কাছে পেশ করা হলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা কী?’ সাহাবিগণ বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এটা সান্ডা।’ তখন তিনি তা ধরা থেকে বিরত থাকলেন এবং বললেন, ‘এটা আমার কওমের এলাকায় পাওয়া যায় না, তাই আমি এটিকে অপছন্দ করি।’ খালিদ (রা.) বলেন, ‘তখন আমি সেটি টেনে নিয়ে খেলাম, আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, কিন্তু তিনি আমাকে নিষেধ করেননি।’" [সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৫৩৮৯]
এই হাদিসগুলো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে সান্ডা না খেলেও, তিনি সাহাবিদের তা খেতে নিষেধ করেননি। বরং তাঁর সামনে সাহাবিদের খাওয়া তিনি নীরবভাবে সমর্থন করেছেন।
বিভিন্ন মাজহাবের মতামত:
- শাফেয়ি, মালিকি ও হাম্বলি মাজহাব: এই মাজহাবের আলেমগণ উপরোক্ত হাদিসগুলোর ভিত্তিতে সান্ডা খাওয়াকে হালাল বলে মনে করেন। যেহেতু নবী (সা.) এটিকে হারাম ঘোষণা করেননি এবং সাহাবিদের খেতে বাধা দেননি, তাই এটি বৈধ খাদ্য।
- হানাফি মাজহাব: হানাফি মাজহাবের আলেমগণ সান্ডা খাওয়াকে মাকরূহ তাহরিমি (অপছন্দনীয়) বলেছেন। এর কারণ সম্ভবত প্রাণিটির স্বভাব, বাহ্যিক রূপ এবং সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে এর প্রতি অনীহা। তবে এটিকে সরাসরি হারাম বলা হয়নি।
সান্ডার চিকিৎসাগত ব্যবহার:
যদিও আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে সান্ডার তেলের কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবে ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা পদ্ধতিতে বিশেষত আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রে এবং কিছু সংস্কৃতিতে যৌন শক্তি বৃদ্ধিকারক উপাদান হিসেবে এর ব্যবহার প্রচলিত।
সারসংক্ষেপ:
কুরআনে সান্ডা নিয়ে সরাসরি কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও, হাদিসের আলোকে এটি স্পষ্ট যে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে না খেলেও সাহাবিদের খেতে নিষেধ করেননি। এই কারণে শাফেয়ি, মালিকি ও হাম্বলি মাজহাবে এটি হালাল। তবে হানাফি মাজহাবে এটিকে মাকরূহ তাহরিমি বলা হয়েছে।
অতএব, সান্ডা খাওয়া হারাম নয়, বরং অধিকাংশ আলেমের মতে হালাল। তবে ব্যক্তিগত অপছন্দ বা রুচির ভিন্নতা এক্ষেত্রে একটি বিবেচ্য বিষয় হতে পারে। ইসলামে সেই সকল খাদ্যই মূলত হালাল যা স্বাস্থ্যসম্মত এবং স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ নয়।